Print this page
সোমবার, 16 জুলাই 2012 03:40

সাঁওতালপল্লি পারুয়াবিল

Rate this item
(0 votes)

চারদিক

সাঁওতালপল্লি পারুয়াবিল

| তারিখ: ১৬-০৭-২০১২

 সূর্যটা ঠিক মাথার ওপর নয়, বেশ হেলে পড়েছে। সে রকম রোদ পড়া সময়টিতে একটি চা-বাগানের কাঁচা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। সরাসরি মুখের ওপর রোদ পড়ছে। এতে চামড়া সেঁকার স্বাদটা ভালোই অনুভূত হচ্ছে। কিন্তু উপায় নেই। যেখানে যেতে হবে, হাঁটার কোনো বিকল্প নেই।

 


মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার ভানুগাছ চৌমোহনা থেকে মাধবপুর চা-বাগানের মাধবপুর বাজার এলাকায় এসে সিএনজিচালিত অটোরিকশা থেকে নেমে এই কাঁচা পথ ধরতে হয়েছে। সঙ্গে আছেন লোকগবেষক আহমদ সিরাজ। কিছুটা বাতাস আছে। কিন্তু সড়কের দুই পাশের মাঠ থেকে ভাপ ছড়ানো জল ছুঁয়ে আসা হাওয়া বেশ গরম। এসব মাঠের ওপর দিয়ে পাহাড়ি ঢল গেছে। বিভিন্ন স্থানে নারী-পুরুষ ও শিশু মিলে জমি সেচে মাছ ধরছে। খুব একটা মাছ পাওয়া যাচ্ছে, এমন নয়। এই পুঁটি, কইয়ের পোনা, খলশে, দারকিনা—এ রকম কিছু মাছ। কিন্তু তাদের কাদালেপা চেহারা দেখে টের পাওয়া যায়—সবাই এখন উৎসবের মেজাজে আছে। এই রোদ, গরম—কিছুই তাদের গায়ে লাগছে না। হয়তো জীবন এ রকমই, সামান্য ঘটনা থেকেই সামনে এগিয়ে যাওয়ার জ্বালানি বা শক্তি সংগ্রহ করতে পারে। যার জন্য তেমন কোনো আয়োজন, ঢাকঢোল পেটানোর প্রয়োজন পড়ে না।
এটা আরও স্পষ্ট হলো আমরা যখন মাধবপুর চা-বাগানের পারুয়াবিলপাড়ায় হাজির হলাম। সেটি একটি সাঁওতালপল্লি। চা-বাগানগুলোতে আদিবাসী পরিচয়ে নয়, চা-শ্রমিক পরিচয়ে অনেক সাঁওতাল আছে। এটা জানা ছিল। কিন্তু একদম নিখাদ একটি সাঁওতালপাড়া বা পল্লি আছে, এটা জানতাম না (যদি না আহমদ সিরাজ জানাতেন)। একটি ছড়ার (খাল) পাড় ধরে সাঁওতালপাড়ায় গিয়ে আহমদ সিরাজ কার যেন খোঁজ করলেন। পরিপাটি, কিন্তু বিক্ষিপ্তভাবে সাজানো একটি বাড়ি থেকে যিনি বেরিয়ে এলেন, তাঁর নাম লালবাবু সেরেন। বয়স বছর ৫০। আন্দাজ করতে অসুবিধা হয় না, এই পল্লিটির সঙ্গে বাইরের যোগসূত্র তৈরি বা রক্ষার কাজটি তিনি করেন। এখানে তাঁদের বসতি গড়ে ওঠার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি আরও একজনের খোঁজ করলেন। ছিপছিপে কালো রঙের যে মানুষটি পাশের বাড়ি থেকে এলেন, তাঁর নাম জীবন সাঁওতাল। সত্তরোর্ধ্ব বয়স। মুখের রেখায় যেন দীর্ঘ এক জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত, বঞ্চনা, হতাশা, অনেক কিছু না পাওয়ার কষ্ট দলামোচড়া হয়ে জমে আছে। অথবা সেখানে এই পণ্যজীবী, ভোগবাদী, পুঁজির স্তুতিপাঠময় সময়ের আরও চাওয়া, আরও পাওয়া—সবকিছু আত্মকেন্দ্রে নেওয়ার অমানবিক উন্মত্ততা কিছুই হয়তো তাঁকে স্পর্শ করেনি। তেমন কোনো প্রশ্ন ছাড়াই বেঁচে থাকার একটা জীবন তাঁকে এই সত্তর বা তারও বেশি সময়ের প্রান্তে নিয়ে এসেছে। জীবন সাঁওতাল বললেন, ‘আমাদের পূর্বপুরুষ ভারতের ডুমকা জেলা থেকে এসেছিলেন।’ এর বেশি তাঁর কাছে আর কোনো তথ্য নেই। কোনো দিন সেসব জায়গায় যাওয়া হয়নি।
তাঁরা জানালেন, পারুয়াবিলে তারা প্রায় ৫০টি পরিবার আছে। এখানে একটা সময় পারুয়া নামের এক ধরনের বাঁশ জন্মাত। সেই বাঁশের নামেই হয়তো পারুয়াবিল নামকরণ। এর মধ্যে স্রোত গড়িয়েছে অন্যদিকেও। এই পল্লির অর্ধেক পরিবারই খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেছেন। অর্ধেক আদি ধর্মটিই আঁকড়ে আছেন। তবে ধর্ম তাঁদের ভাগ করলেও সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধনটি এখনো অটুট। জীবন সাঁওতাল বললেন, ‘আমাদের অনুষ্ঠানে নাচগান সবকিছু ঠিক আছে। ফুর্তিটা সবাই করি।’ তিনি জানালেন, এমনিতে দুই ধর্ম বলে সামাজিক রীতিতে তাঁদের মধ্যে বিয়ে হয় না। কিন্তু ছেলেমেয়ের মধ্যে প্রেম হলে সেটা দুই পক্ষই মেনে নেয়। পৌষ ও ফাল্গুন মাসে আদি ধর্মাবলম্বীরা মারাং বুরু দেবতার পূজা করেন। সবাই মিলে খাওয়াদাওয়া করেন, হাঁড়িয়া পান করেন।
তাঁরা প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে বেড়ে উঠেছেন বলেই হয়তো প্রকৃতির নিয়মকানুন তাঁদের রক্তের সঙ্গে মিশে আছে। তাঁরা শিকারি জাত। তির-ধনুক নিয়ে খাদ্যের খোঁজে শিকারে বের হওয়া ছিল পেশা। বাবুরাম সেরেন বলেন, ‘বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসে আমরা শিকার করি না। এ সময় পাখি বাচ্চা দেয়। শিকার নিষেধ। মাকে মারলে বাচ্চাও মারা যাবে।’ এটা কোনো সেমিনার-সিম্পোজিয়াম বা গবেষণাপত্রের ভাষা নয়। একদম জীবন থেকে শেখা। যে জীবন এখনো ফুরিয়ে যায়নি। যে জীবন হতে পারে অনেক বেশি বৈচিত্র্যপূর্ণ, শান্তির, সমন্বয়ের, উৎসবের, সেই জীবনকে দলে কি না আমাদের প্ররোচনা প্রাকৃতিক নিয়মকে ভেঙে তছনছ করে আত্মকেন্দ্রিক সমাজ বিনির্মাণের দিকে। জীবন সাঁওতাল বলেন, ‘প্রায় তিন পুরুষ আছি এখানে। কিন্তু নিজের কোনো জায়গা হলো না।’ এর কী উত্তর হতে পারে, জানা নেই।
এ সময় লালবাবু সেরেন জানালেন, সেদিন সকালেই একটি শিশু ভূমিষ্ঠ হয়েছে তাঁদের পল্লিতে। কী একটা সমস্যা হয়েছে। হাসপাতালে মা ও শিশুকে নিয়ে যাবেন। কিন্তু চেনাজানা না থাকলে কেউ গুরুত্ব দেয় না। ভালো চিকিৎসাসেবা মেলে না। অসহায় লাগছে তাঁকে। আহমদ সিরাজ মুঠোফোনে যেন কার কার সঙ্গে কথা বললেন। পারুয়াবিল থেকে এক ত্রাতার মতো মা ও শিশুকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে বাইসাইকেলে ছুটলেন লালবাবু সেরেন। মনে হলো, জীবন হয়তো এ রকমও—কারও না কারও হাত ধরে টিকে থাকে, সামনে এগিয়ে যায়।

আকমল হোসেন
মৌলভীবাজার

সৌজন্যে: দৈনিক প্রথম আলো

Read 278403 times